কমলা রঙের সকাল….হলুদ দুপুর….সবুজ বিকেল….ধুসর সন্ধ্যে…..এরপর দিন গড়িয়ে কুচকুচে কালো রাত। অর্থহীন সময়গুলোকে বর্ণময় করে তোলা। ঠুক ঠুক ঠুক…..কাজ চলছে। মাঝে মাঝে টুকুর টাকুর কথা। জামার হাতায় ঘাম মোছা। সাদা কিংবা হালকা রংয়ের শার্টে কালসিটা। মুখ শরীর ধুলো-বালিতে মাখামাখি।
-হাত ছাড়ো, মানুষ বলবে কি? শতাব্দীর রিনঝিনে আদুরে নিষেধ।
-কাজের সময় কথা বলতে নেই, সোনা। মাহিন শতাব্দীর অনামিকায় আংটি পড়াতে পড়াতে বলে, ‘‘দেখো তো এটা পছন্দ হয় কি না!’’
শতাব্দী আবার চুপ মেরে যায়। ওর স্বভাবটাই এরকম। কখনো সরব কলকল নদী, কখনো শব্দহীন বিরান বনভূমি। বচনে চলনে এই চঞ্চল ঊর্মিমালা, আবার হঠাৎ শান্ত মরুর বালিয়াড়ি।
আঁধার হয়ে আসছে চারিদিক। তাড়াতাড়ি কাজ নামিয়ে নেবার তাড়া মাহিনের। হাত দ্রুত চলে। অজান্তে চোখ কচলায় নজরে বাড়তি শক্তি পাবার আশায়।
-ছিঃ মাহিন! এত অসভ্য কবে হলে? ওসব জায়গায় এভাবে হাত দেয়? অস্ফুট প্রতিবাদে ফেটে পড়ে আবার পাথরমুখ শতাব্দী।
কান দেয় না মাহিন। পেলব হাতে কাজ করে চলে। কখনও আলতো ছোঁয়া। কখনও নিষ্ঠুর হাতুড়ি বাটাল।
উহ আহ…শীৎকার চিৎকার! শতাব্দীর মৃদু সংলাপ অন্তরে বাইরে অনুভব করে চলে শৈল্পিক প্রেমী।
রাত বাড়ে, কাজের নেশা চড়ে। মনটি মাঝে সাঝে যান্ত্রিক হয়ে উঠলেও শরীর তো রক্ত মাংসেরই থেকে যায়। তাই ক্লান্ত হয়। কখন যেন শতাব্দীকে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে পড়ে মাহিন।
ধড়মড় করে উঠে পড়ে। বাহুতে আবদ্ধ কিলবিল সর্পিল নড়াচড়া বোধহয় জাগিয়ে দেয় তাকে। রাতের মধ্যপ্রহর।
-ইসস্...তোমাকে এভাবে রেখে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। কাঁচা ঘুম ভাঙা মাহিনের চমকিত সলাজ স্বর।
শুনশান চারিদিক। হাতিয়ার হয়ে ওঠে আবার প্রেমিকের হাত। শিল্পী ও সৃষ্টি অনেকক্ষণ উভয়ে নিরব। হঠাৎ শতাব্দীর মৃদু ধিক্কার।
-হতেই পারে না। ওটা আমার নয়। যেই ঠোঁটে চুমু না খেলে নাকি পিয়াস মেটে না তোমার। কফি মগে লিপস্টিক চিহ্ন স্যুভেনির করে রাখো। সেটা কি এতই পলকা? আরেকটু পুরুষ্টু করো।
….হ্যাঁ, যেমন চাইতাম নাকটি কিন্তু তেমনি বাঁশীর মতো হয়েছে। কতবার বলেছিলাম প্লাস্টিক সার্জারি করিয়ে বোঁচা নাকটি ঠিক করে দাও। আজ নিজের হাতে করে দিলে! - দীর্ঘনিঃশ্বাস।
-হুম, তবে আরেকটু বড় করো। আর নীল রংটা আরো গাঢ় করে আমার কষ্টের কাছাকাছি এনে দাও।
-এটা দেখো, পছন্দ হয় কিনা। শতাব্দীর গভীর কালো চোখ নিয়ে ব্যস্ত মাহিনের অস্ফুট উচ্চারন।
-না না না, মরে গেলেও বলবো না। যে চোখের বন্দনায় প্রেমিক জীবনের ষোলটি বছর কাটিয়েছ, সেটি নিজের মতই আঁকো। ওটা তোমাকে ছেড়ে দিলাম। বলেই শতাব্দী মুখে কুলুপ আটে।
শেষ প্রহরটি প্রিয় জায়গাতেই কাটে মাহিনের। ভাস্কর জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ কাজটি যেন এই নয়ন জোড়াতেই ফোটাবে। এই নজরই পাগল করেছিল মাহিনকে। বয়স, পেশা, সামাজিক অবস্থান সব খেলো হয়ে যায় ঐ সর্বনাশা নীল নয়নের কারণে। আজো কি সেভাবে তাকিয়ে আছে নির্বাক শতাব্দী? কি জানি, দেখার সাধ্য নেই। নিবিষ্ট মনে আন্দাজে চোখে কাজল পড়ায়। ওটা নাকি চোখকে টানা করে।
মাহিনের প্রায় প্রতিবন্ধ চোখ দু’টি থেকে অশ্রুর ধারা বয়। মনপ্রাণ ঢেলে দেয়া কাজে রাজ্যের অক্ষমতা ঘিরে ধরেছে শিল্পীকে। দৃষ্টিশক্তি আর কাজ করতে চাইছে না। চশমার কাঁচ যেন বালিতে ঘষা খাওয়া। দৃষ্টি বাড়াবে কি, নজরই পার হচ্ছে না ওটা দিয়ে।
গ্লুকোমা চোখ কেন খাচ্ছে, তার বদলে কেন একটা ক্যান্সার পুরো দেহটি খেলো না! হাত মন দেহ সব চালু, হৃদপিণ্ডের কলটিও ঠিকঠাক চলছে। শুধু নজর অন্ধকার হয়ে আসছে। হাতড়ে হাতড়ে শেষ ছোঁয়া দিয়ে চলেছে তবু। শতাব্দীও সাহায্য করবে না।
শেষবার বলে দিয়েছে, ‘‘অন্তরের দৃষ্টিতে আঁকো। মরা পাথর যদি কথা বলতে পারে। তবে হৃদয়ে গাঁথা ছবি কেন হাতের কাজে ফুটবে না?’’
নিঁখুত হিসেবে ছুঁয়ে ছুঁয়ে কাজ শেষ করে এনেছে। স্মৃতির ছোঁয়া বর্ণময় হয়ে উঠেছে উপলের বহিরাঙ্গে। বাইরে একটু একটু আলো ফুটছে। ভোরে ওঠা হয়নি অনেক দিন মাহিনের। শহরেও এত পাখি ডাকে! পাখির ডাকটুকুই কানে যায়। আলোটুকু নজর ভেদ করে না। ক্লান্ত শরীর ঘুমহীন রাত্রির অবসাদে একটু গড়িয়ে নিতে চায়।
রনীল
শিল্পীর সাথে শিল্পর প্রেম... ! অসাধারণ সব ডায়লগ... টুইস্ট টা খুব বেশি সাংঘাতিক বা আকস্মিক ছিলনা... বরং কিছুটা আভাস পাওয়া যাচ্ছিল... সেটাই গল্পটাকে নিয়ে গেছে অন্য মাত্রায়... অপূর্ব অপূর্ব...
মিলন বনিক
অল্প কথা কিন্তু পুরোটা জুড়ে একটা মায়াময় স্বপ্নিল আবেশে মুগ্ধ হয়ে ছিলাম..দেবী প্রতিমার দৃষ্টি ফুটানো হয় সব শেষে আপনিও তাই করেছেন অসাধারণ ভাবে..নিয়ত শুভ কামনা...
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।